উদ্ভিদের জিংকের অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা গাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। জিংক একটি প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র উপাদান যা উদ্ভিদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে যখন গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে জিংক শোষণ করতে পারে না, তখনই এই ঘাটতি দেখা দেয়।
জিংকের অভাবজনিত লক্ষণ
ভিন্ন ভিন্ন ফসলে জিংকের অভাবের লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়—
- পাতার হলদে হয়ে যাওয়া (Chlorosis): পাতার শিরার মাঝখানের অংশ হলুদ হয়ে যায়, তবে শিরাগুলো সবুজ থাকে। এটি সাধারণত নতুন পাতায় বেশি স্পষ্ট হয়।
- মৃত কোষের দাগ (Necrotic Spots): পাতার টিস্যু শুকিয়ে যায় এবং বাদামি বা কালচে দাগ দেখা দেয়।
- গাছের বৃদ্ধি কমে যাওয়া (Stunting): গাছের উচ্চতা কমে যায় এবং কাণ্ড ও পাতা ছোট হয়ে যায়।
- পাতার বিকৃতি (Leaf Malformation): পাতাগুলো সরু হয়ে যেতে পারে, কিনারা ঢেউখেলানো বা অস্বাভাবিক আকৃতির হতে পারে।
- পাতার গুচ্ছাকৃতি (Rosetting): ডাইকোট (যেমন টমেটো বা বেগুন) গাছের কাণ্ডের গাঁট খুব কাছাকাছি হয়ে পাতাগুলো গুচ্ছাকৃতিতে পরিণত হয়।
- খর্বকায় পাতা (Dwarf Leaves): ছোট ছোট পাতা গজায়, যেগুলো অনেক সময় হলুদ বা শুকিয়ে যেতে পারে।
এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উৎপাদন কমে যায়।
জিংকের অভাবে উদ্ভিদে সৃ্স্ট সমস্যা
জিংকের অভাব সরাসরি কোনো রোগ সৃষ্টি না করলেও গাছকে নানা সমস্যার মুখে ফেলে দেয়—
- পোকার আক্রমণের আশঙ্কা: দুর্বল গাছ সহজেই কীটপতঙ্গের আক্রমণের শিকার হয়
- ফসলের গুণগত মান কমে যায়: ফল ও সবজির আকৃতি ছোট হয়, রং ও স্বাদ খারাপ হতে পারে।
জিংকের ঘাটতি দূর করার কার্যকর উপায়
জিংকের অভাব দূর করতে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা যায়। ফসলের ধরন ও চাষের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে জিংক প্রয়োগ করা উচিত।
প্রচলিত পদ্ধতি (Conventional Methods)
- মাটিতে প্রয়োগ: জিংক সালফেট বা জিংক অক্সাইড সরাসরি মাটিতে প্রয়োগ করা যায়। সাধারণত ৫-১০০ কেজি/হেক্টর প্রয়োগ করা হয়, যা ফসলের ধরন ও ঘাটতির মাত্রার ওপর নির্ভর করে।
- পাতায় স্প্রে: ফুল ফোটার বা ফল ধরার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জিংকযুক্ত স্প্রে (যেমন ০.৫% জিংক সালফেট দ্রবণ) ব্যবহার করলে দ্রুত ফল পাওয়া যায়।
- বীজ প্রক্রিয়াকরণ: বীজ বপনের আগে জিংকযুক্ত দ্রবণ দিয়ে শোধন করলে গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি ভালো হয়।
জৈব পদ্ধতি (Organic Methods)
- মাটির pH নিয়ন্ত্রণ: মাটির pH ৬.০-৭.০ এর মধ্যে থাকলে জিংকের সহজলভ্যতা বাড়ে।
- কম্পোস্ট ও জৈব সার প্রয়োগ: কম্পোস্ট বা পচা গোবর ব্যবহার করলে মাটির গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং জিংকের কার্যকারিতা বাড়ে।
- ফসল চক্র (Crop Rotation) ও কভার ক্রপ: ওটস বা রাই জাতীয় ফসল চাষ করলে মাটিতে জিংকের ঘাটতি কমতে পারে।
- প্রাকৃতিক স্প্রে: সামুদ্রিক শৈবাল নির্যাস বা চিলেটেড জৈব জিংক প্রয়োগ করলে জৈব কৃষিতে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ভিন্ন ফসলের জন্য সুনির্দিষ্ট জিংক প্রয়োগ পদ্ধতি
ফসলভেদে জিংকের প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জন্য প্রস্তাবিত মাত্রা দেওয়া হলো—
- ধান ও গম: মাটিতে ১০-২৫ কেজি/হেক্টর জিংক সালফেট প্রয়োগ করুন; প্রয়োজন হলে ০.৫% জিংক স্প্রে দিন।
- ফল গাছ (কমলা, আপেল): প্রতি গাছে ৫০-১০০ গ্রাম জিংক সালফেট প্রয়োগ করুন; গাছ বৃদ্ধির সক্রিয় পর্যায়ে পাতায় স্প্রে করুন।
- সবজি (টমেটো, মরিচ): মাটিতে ৫-১০ কেজি/হেক্টর প্রয়োগ করুন; ২-৩ সপ্তাহ পরপর ০.২-০.৩% দ্রবণ স্প্রে করুন।
সংক্ষেপে
- জিংকের অভাব গাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদন কমিয়ে দেয়।
- লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করে সঠিক ব্যবস্থা নিলে ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
- মাটিতে প্রয়োগ, পাতায় স্প্রে ও জৈব পদ্ধতির মাধ্যমে জিংকের অভাব দূর করা যায়।
- নিয়মিত মাটির পরীক্ষা করলে এ সমস্যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আপনার জমিতে জিংকের অভাব আছে কি না, তা দ্রুত যাচাই করুন এবং সঠিক পদক্ষেপ নিন!