বিভিন্ন বয়সে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা: কেন এবং কতটুকু?

কর্তৃক সরকারি আদেশ
0 মন্তব্য 111 views

ঘুমের গুরুত্ব আমরা সকলেই কমবেশি জানি, কিন্তু এর প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা এবং আমাদের শরীর ও মনের উপর এর প্রভাবের গভীরতা অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না। ঘুম শুধু শরীরকে বিশ্রাম দেয় না, এটি আমাদের মস্তিষ্ককে নতুন অভিজ্ঞতা প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলে। এর অভাব আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের ঘুমের প্রয়োজনও পরিবর্তিত হয়। এই ব্লগ পোস্টে, আমরা বয়সভেদে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা এবং এর কারণগুলো বিশ্লেষণ করব, যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে কোন বয়সে কতটুকু ঘুম জরুরি।

 

নবজাতক ও শিশু (০-৩ মাস):

  • ঘুমের সময়: ১৪-১৭ ঘণ্টা

নবজাতক শিশুরা তাদের জীবনের প্রথম কয়েক মাসে প্রায় সারাক্ষণ ঘুমায়। কেননা এই সময়েই তাদের শরীর দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিষ্ক নতুন সংযোগ গড়ে তোলে। একজন নবজাতকের জন্য ঘুম শুধু বিশ্রামের বিষয় নয়; এটি তাদের শরীরের বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

গভীর ঘুমের মধ্যে থাকাকালীন মস্তিষ্ক সারা দিনের অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে এবং দেহের কোষ পুনর্গঠিত হয়। শিশুরা এই সময়ে ঘুমিয়ে থেকেই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।

একটি নবজাতক শিশু তার মায়ের বুকে বয়স অনুযায়ী খুমাচ্ছে ।

নবজাতক শিশু মায়ের বুকে । ছবি সংগ্রহঃ www.pexels.com

 

শিশু (৪-১১ মাস):

  • ঘুমের সময়: ১২-১৬ ঘণ্টা

শিশুদের সার্কাডিয়ান রিদম, অর্থাৎ দিন ও রাতের প্রাকৃতিক চক্রের সাথে ঘুমের সম্পর্ক, এই বয়সে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে তারা সক্রিয় থাকে এবং রাতে ঘুমায়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করে।

এই বয়সের শিশুরা অনেক নতুন কিছু শেখে, যেমন— কথা বলা, হাঁটতে শেখা এবং পরিবেশের সাথে যোগাযোগ করা। এগুলো সবই ঘুমের মধ্যে গড়ে ওঠা স্নায়ুবিক সংযোগের ফলাফল। পর্যাপ্ত ঘুম শিশুদের বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

টডলার (১-২ বছর):

  • ঘুমের সময়: ১১-১৪ ঘণ্টা

এক থেকে দুই বছরের বাচ্চাদের মধ্যে শারীরিক বিকাশের সাথে সাথে তাদের চলাফেরা ও স্বাধীনতার ইচ্ছা বাড়তে থাকে। যদিও এই বয়সে ঘুমের সময় কিছুটা কমে যায়, তবুও তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং শরীরের বৃদ্ধির জন্য ঘুম অপরিহার্য।

এই সময়ে তাদের দৈনিক কার্যকলাপ অনেক বেড়ে যায়, তাই শারীরিক ও মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধারে ঘুম বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাচ্চারা এ বয়সে যখন ঘুমায়, তাদের মস্তিষ্ক নতুন অভিজ্ঞতাগুলোকে সাজিয়ে নেয় এবং সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করে।

এক থেকে দুই বছরের বাচ্চা বিছানায় ঘুমাচ্ছে ।

মেয়ে বাচ্চা । ছবি সংগ্রহঃ www.pexels.com

 

প্রিস্কুলার (৩-৫ বছর):

  • ঘুমের সময়: ১০-১৩ ঘণ্টা

প্রিস্কুলার বয়সে শিশুদের কল্পনা শক্তি তীব্রভাবে বিকশিত হয়। তারা নতুন নতুন কাহিনী গড়ে তোলে এবং রাতের অন্ধকারে কল্পনাশক্তির কারণে কখনও কখনও ভয় পায়। এসব কারণেই অনেক সময় তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। তবুও, এই বয়সে পর্যাপ্ত ঘুম শিশুদের শারীরিক বিকাশ, স্মৃতিশক্তি এবং সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ঘুমের অভাব হলে আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন অতিরিক্ত দুষ্টুমি বা মনোযোগের অভাব।

 

স্কুলগামী শিশু (৬-১৩ বছর):

  • ঘুমের সময়: ৯-১১ ঘণ্টা

স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে শারীরিক বৃদ্ধি, শিক্ষার চাপ এবং সামাজিক পরিবর্তনের কারণে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ বয়সে শিশুরা প্রচুর শিখছে এবং শরীরের শারীরিক বিকাশও ত্বরান্বিত হয়।

ঘুম না হলে তাদের স্কুলের কাজে মনোযোগের অভাব হতে পারে এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পর্যাপ্ত ঘুম শিশুরা যাতে সঠিকভাবে শেখার এবং নতুন দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়, তা নিশ্চিত করে।

 

কিশোর (১৪-১৭ বছর):

  • ঘুমের সময়: ৮-১০ ঘণ্টা

কিশোর বয়সে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশের পাশাপাশি হরমোনাল পরিবর্তনও ঘটে, যা তাদের ঘুমের ধরণকে প্রভাবিত করে।

অধিকাংশ কিশোররা স্কুলের চাপ, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো এবং সামাজিক যোগাযোগের কারণে প্রায়শই রাতে দেরি করে ঘুমায়। এই কারণে ঘুমের সময় কমে আসে, যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে কিশোরদের মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা বৃদ্ধি পায়।

 

প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৬৪ বছর):

  • ঘুমের সময়: ৭-৯ ঘণ্টা

প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দৈনন্দিন কাজের চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব এবং আর্থিক চাপের কারণে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা প্রায়শই অবহেলিত হয়। তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ঘুমের অভাব কর্মদক্ষতা হ্রাস করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলে।

এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়, যেমন— উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি। ঘুম আমাদের মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ করে এবং পরবর্তী দিনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে।

 

প্রবীণ (৬৫+ বছর):

  • ঘুমের সময়: ৭-৮ ঘণ্টা

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে, যা ঘুমের প্রয়োজনীয়তাকে প্রভাবিত করে। প্রবীণদের মধ্যে ঘুমের সময় কিছুটা কমে আসে । অনেকেই গভীর ঘুম পেতে সমস্যাও অনুভব করেন। আর্থ্রাইটিস, স্নায়বিক সমস্যা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে তারা প্রায়ই রাতে ঘুমাতে পারেন না এবং দিনে ঘুম ঘুম ভাব থাকে। তবুও, পর্যাপ্ত ঘুম তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের অভাবে প্রবীণদের মাঝে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি থাকে

৬৫ উর্দ্ধ একজন প্রবীণ ব্যাক্তি গভীর ঘুম পেতে সমস্যা অনুভব করছেন ।

একজন প্রবীণ ব্যাক্তি । ছবি সংগ্রহঃ www.pexels.com

 

উপসংহার:

সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেকোনো বয়সে থাকি না কেন, সঠিক পরিমাণে ঘুম নিশ্চিত করা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। তাই নিজের এবং পরিবারের জন্য ঘুমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতন হওয়া এবং তা অনুসরণ করা উচিত। ভালো ঘুম মানেই ভালো জীবন।

 

FAQ (Frequently Asked Questions)

১. প্রশ্ন: ঘুমের সময়সীমা কি প্রতিটি বয়সের জন্য একই হওয়া উচিত?

উত্তর: না, ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বয়সভেদে পরিবর্তিত হয়। নবজাতক থেকে শুরু করে প্রবীণ পর্যন্ত সবার ঘুমের প্রয়োজন ভিন্ন। ছোট শিশুদের বেশি ঘুমের প্রয়োজন হয়, কারণ তাদের শরীর ও মস্তিষ্ক দ্রুত বৃদ্ধি পায়। প্রবীণদের ঘুমের প্রয়োজন কম হলেও, তাদের ঘুমের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২. প্রশ্ন: কিশোরদের ঘুমের ঘাটতি কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে?

উত্তরঃ: কিশোরদের ঘুমের ঘাটতি তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ঘুমের অভাবে তারা বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মনোযোগের অভাব এবং মেজাজের পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে পারে। এটি তাদের শিক্ষার মানেও প্রভাব ফেলতে পারে।


৩. প্রশ্ন: প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ঘুমের অভাব দীর্ঘমেয়াদে কী ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে?

উত্তর: প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ঘুমের অভাব দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এবং ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং উদ্বেগ ও বিষণ্নতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।


৪. প্রশ্ন:প্রবীণদের কম ঘুমানো স্বাভাবিক কি?

উত্তর: প্রবীণদের ক্ষেত্রে ঘুমের সময় কিছুটা কমে যেতে পারে, যা স্বাভাবিক। তবে, গভীর ঘুম পেতে সমস্যা হলে তা নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত। ঘুমের গুণমান বজায় রাখা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।

৫. প্রশ্ন: রাতে ভালো ঘুমের জন্য কী করা উচিত?

উত্তর: রাতে ভালো ঘুম পেতে একটি রুটিন মেনে চলা জরুরি। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া, ক্যাফেইন ও ভারী খাবার এড়ানো, এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করা উচিত। এছাড়া, ঘুমানোর আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস কম ব্যবহার করাও উপকারী হতে পারে।

তথ্য সূত্রঃ 

[1] https://www.kuakini.org/wps/portal/public/Health-Wellness/Health-Info-Tips/Sleep/Myths-and-Facts-About-Sleep
[2] https://www.healthline.com/health/healthy-sleep/your-sleep-needs-change-as-you-age-heres-what-you-need-to-know
[3] https://www.medicinenet.com/how_much_sleep_do_you_need_by_age/article.htm
[4] https://www.gwhospital.com/frequently-asked-questions-about-sleep
[5] https://health.clevelandclinic.org/recommended-amount-of-sleep-for-children
[6] https://www.sleepmattersperth.com.au/answers-to-5-of-your-most-common-questions-about-sleep/
[7] https://www.sleep.com/sleep-health/how-many-hours-of-sleep
[8] https://www.sleepscore.com/blog/8-most-frequently-asked-sleep-questions/
[9] https://www.sleepfoundation.org/how-sleep-works/how-much-sleep-do-we-really-need
[10] https://time.com/7016186/how-much-sleep-do-you-need-age/

রিলেটেড আরও পোস্ট

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.