প্রতিদিনের মতোই ভোরের আলো ফুটছিল বুরুন্ডিতে। এক মা তার অসুস্থ চার বছরের সন্তানকে বুকে নিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে হাসপাতালের দিকে রওনা হলেন। তার পিঠে বেঁধে রাখা নবজাতক শিশুটিও সাথে ছিল। বাচ্চাটির শরীরে চুলকানো ঘা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল, আর তার কান্না থামছিল না। শেষমেশ হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকরা জানালেন যে, ছেলেটির মাঙ্কিপক্স হয়েছে এবং তাকে আলাদা ভবনে স্থানান্তর করতে হবে। বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তথ্য মতে এ ধরনের দৃশ্য প্রতিদিনই মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে ঘটছে। বিশেষত বুরুন্ডি, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (DRC), এবং রুয়ান্ডার মতো দেশগুলোতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতা
২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মধ্য আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্সকে জনস্বাস্থ্যের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগজনক বলে ঘোষণা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই রোগটি থাকলেও নতুন Clade Ib স্ট্রেইন আক্রমণ শুরু করার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। WHO-র এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক সাড়া দেওয়ার জন্য ছিল, তবে মাঠ পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া এখনো কমই দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কেন সতর্ক হওয়া উচিত?
বাংলাদেশে আমরা যতই নিজস্ব জনস্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকি না কেন, আন্তর্জাতিক মহামারী বা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কখনোই দূরে নয়। ২০১৯ সালে কোভিড-১৯-এর উদাহরণ আমাদের জন্য যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছে। যখন মধ্য আফ্রিকার মতো অঞ্চলগুলোতে মাঙ্কিপক্সের মতো বিপজ্জনক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন বাংলাদেশকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। কারণ, মাঙ্কিপক্স বা এর মতো অন্য যে কোনো সংক্রামক রোগ এক দেশ থেকে অন্য দেশে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে, বিশেষত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত, কারণ এমন প্রাদুর্ভাব সহজেই আমাদের দেশে আঘাত হানতে পারে।
মধ্য আফ্রিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংকট ও চ্যালেঞ্জ
মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো তাদের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বুরুন্ডি এবং কঙ্গোর মতো দেশগুলোতে ভ্যাকসিন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এমনকি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবারও অভাব রয়েছে।
একটি মা যখন অসংখ্য ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে আসে এবং তাকে বলা হয় তার নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে, তখন তার সামনে আর কোনো বিকল্প থাকে না। কেননা মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ ত্বক থেকে ত্বকেও ছড়াতে পারে। কিন্তু সে যদি তার সন্তানকে খাওয়ানো বন্ধ করে, তবে শিশুটি ক্ষুধার্ত থাকবে। এই ধরনের পরিস্থিতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং পরিবারের জীবনে দুর্ভোগ নিয়ে আসে।
বাংলাদেশেরও এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে যদি আমরা এখনই সতর্ক না হই। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি এমন কোনো প্রাদুর্ভাবের জন্য প্রস্তুত? যদি না হয়, তবে আমাদের কী করতে হবে তা ভেবে দেখা উচিত।
বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
মধ্য আফ্রিকার প্রাদুর্ভাব আমাদের শেখায় যে সংক্রামক রোগ মোকাবেলায় আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা দুর্বল হতে পারে। বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স বা এমন অন্য কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়লে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত কীভাবে এই সংকট মোকাবেলা করতে পারে তা এখনই মূল্যায়ন করা জরুরি।
জনসচেতনতা বাড়ানো, দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, এবং ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মান উন্নত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে
মাঙ্কিপক্স, যা বর্তমানে এমপক্স নামে পরিচিত, একটি সংক্রামক রোগ যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিচে কিছু কার্যকর প্রস্তুতির উপায় উল্লেখ করা হলো:
১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
- সচেতনতা ক্যাম্পেইন: সরকার এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোকে জনসাধারণের মধ্যে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ, সংক্রমণের উপায় এবং প্রতিরোধের কৌশল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- হটলাইন সেবা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষ হটলাইন চালু করেছে, যেখানে কেউ মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত যোগাযোগ করতে পারবেন।
২. সীমান্তে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা:
- স্ক্রিনিং কার্যক্রম: বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরে তাপমাত্রা স্ক্রিনিং এবং লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- বিশেষ নজরদারি: এমপক্স আক্রান্ত দেশ থেকে আগত যাত্রীদের উপর বিশেষ নজরদারি রাখা উচিত।
৩. স্বাস্থ্যসেবা প্রস্তুতি:
- হাসপাতাল প্রস্তুতি: দেশের হাসপাতালগুলোতে মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে হবে।
- প্রশিক্ষণ: স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঙ্কিপক্স শনাক্তকরণ এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে যোগাযোগ: আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করে সর্বশেষ তথ্য ও কৌশল গ্রহণ করা উচিত।
- ভ্যাকসিন ও চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা: যদি প্রয়োজন হয়, তবে ভ্যাকসিন বিতরণ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ করা উচিত।
৫. গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ:
- জ্ঞান ও মনোভাব মূল্যায়ন: মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে চিকিৎসকদের জ্ঞান এবং মনোভাব মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করা উচিত। এটি স্থানীয় পরিস্থিতি ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
৬. স্বাস্থ্য সেবা নেটওয়ার্কের উন্নয়ন:
- সামাজিক নেটওয়ার্ক: স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত।
- সচেতনতা কার্যক্রম: স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য প্রচার এবং সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে, যাতে জনগণ মাঙ্কিপক্সের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হয় ।
বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে এই প্রস্তুতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জনসাধারণের সচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবা প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা হলে এই সংক্রমণ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
উপসংহার
মধ্য আফ্রিকার মাঙ্কিপক্স প্রাদুর্ভাব থেকে আমরা যে শিক্ষাটি নিতে পারি তা হলো, রোগ প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা ও প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশকে এখনই সজাগ হতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এখনো সময় আছে, কিন্তু তা ফুরিয়ে যেতে দেরি নেই। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে মাঙ্কিপক্স বা এর মতো অন্য কোনো সংক্রামক রোগ আমাদের দেশে আরেকটি মহামারী সৃষ্টি করতে না পারে।
মাঙ্কিপক্স নিয়ে ৫টি সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ):
১.মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে এবং এটি মানুষের মধ্যে সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলোর মধ্যে ফুসকুড়ি, জ্বর, মাথাব্যথা, ক্লান্তি এবং শরীরে ব্যথা অন্তর্ভুক্ত।
২.মাঙ্কিপক্স কীভাবে ছড়ায়?
মাঙ্কিপক্স সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক থেকে ত্বক সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়াও, সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আঁচড়, বা শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। আক্রান্তের শরীরের তরল বা সামগ্রী (যেমন পোশাক) স্পর্শ করলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
৩. মাঙ্কিপক্সের প্রধান লক্ষণ কী কী?
মাঙ্কিপক্সের প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে ফুসকুড়ি, জ্বর, মাথাব্যথা, পেশি ব্যথা, ক্লান্তি, লসিকা গ্রন্থির ফোলাভাব এবং ত্বকে ফোসকা বা পুঁজভর্তি ঘা হওয়া অন্তর্ভুক্ত।
৪. মাঙ্কিপক্সের জন্য কি কোনো ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা আছে?
মাঙ্কিপক্সের জন্য বিশেষ কিছু ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রয়েছে, তবে এটি নির্দিষ্ট দেশে সীমিত পরিসরে পাওয়া যাচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সাধারণত উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, যেমন ব্যথা নাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক।
৫. বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঝুঁকি কতটা?
বাংলাদেশে বর্তমানে মাঙ্কিপক্সের বড় ধরনের সংক্রমণ দেখা যায়নি, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও জনস্বাস্থ্য সতর্কতা অনুসরণ করে বাংলাদেশ এই রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে পারে।